Text Practice Mode
গল্পঃ মনের মাঝে
created Apr 20th 2023, 05:50 by MD Fahad Mridha
1
1564 words
2 completed
0
Rating visible after 3 or more votes
00:00
রান্নাঘরের জানলা দিয়ে পশ্চিমের আকাশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুপুর শেষে বিকেল নামার তোড়জোড় চলছে, নীল ক্যানভাসে লালচে- গোলাপির বেখেয়ালি ছোপ। নভেম্বরের মাঝামাঝি শহরের আবহাওয়া অদ্ভুতরকম ভালো। উত্তরদিক থেকে নরম হাওয়া বইছে, তার তালে তালে দিগন্তরেখার কাছে সারি বেঁধে দাঁড়ানো গাছগুলো মেক্সিকান ওয়েভের মতো মাথা দোলাচ্ছে। একবার ওপরে, একবার নীচে- যেন ডুবতে বসা সূর্যকে বিদায় জানাচ্ছে। কুহুহু.. কুহুহু..
কোকিলের ডাকে বেজে ওঠা কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সবজি কাটার বোর্ড আর ছুরি একপাশে সরিয়ে রাখল বিনতা। বাবান স্কুল থেকে ফিরেছে, দরজা খুলতে হবে।
আসছি.. তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ও। ছবির মতো সাজানো দক্ষিণ কলকাতার পশ রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স (স্বর্গদ্বার)- এর দোতলা বাংলোগুলো এমনিতেই বেশ বড়সড়, তার ওপর বাড়ির পেছনদিকের রান্নাঘরটাই বেশি ব্যবহার করে বিনতা। তাই ড্রয়িংরুম পেরিয়ে দরজা খুলতে একটু সময় লেগে গেল।
মাম্মা, আমি এসে গেছি..
[চার মাস আগে]
প্লিজ ডক্টর, কিছু একটা করুন। বিনুর এই অবস্থা আর দেখতে পারছি না আমি। না ভালো করে খাচ্ছে, না ঘুমাচ্ছে। সারাদিন মনমরা হয়ে বাবানের স্কুল ইউনিফর্ম, ড্রয়িং খাতা, কমিকস আগলে বসে থাকে.. ডাকলেও সাড়া দেয় না। মাঝে মাঝে আপন মনে কথা বলে, হাসে, কাঁদে, কখনও আবার শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে, যেন সব কিছু ভুলে গেছে..
রিল্যাক্স, শোভনবাবু। আমি বুঝতে পারছি, আপনাদের জীবন এই মুহূর্তে একটা তোলপাড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনি তাও সামলে উঠেছেন, কিন্তু আপনাদের একমাত্র ছেলে অন্তরীপ- বাবানের এত অল্পবয়সে চলে যাওয়াটা আপনার স্ত্রী এখনও মেনে নিতে পারছেন না। তাই উনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে হলে ওঁর এই ডিলিউশন একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম, বাস্তবের দুঃখ- যন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা। এর বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই, আর সেই লড়াই লড়তে গেলে সবার আগে আপনাকে শক্ত থাকতে হবে।
কী করে শক্ত থাকব, ডক্টর? রোজ রোজ এক জিনিস- আমি যে আর পারছি না। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, জানেন! ভয় হয়, বাড়ি ফিরে বিনুকে কী অবস্থায় দেখব সেই ভেবে। ঘরে বেশিক্ষণ থাকলে পাগল পাগল লাগে, বেডরুমটা যেন হাঁ করে গিলতে আসে। গত পাঁচটা মাস এক বিছানায় শোওয়া সত্ত্বেও একবারও.. আমাদের কনজ্যুগাল লাইফ বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। বারোটা বছর একসঙ্গে কাটানোর পর আজ যেন আমরা হঠাৎ ছিটকে গেছি দুদিকে, দুজন অচেনা মানুষের মতো..
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, মিঃ বিশ্বাস। আত্মীয় পরিজন, পরিবারের সদস্যদের নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। প্রিয়জনকে অকালে হারানোর যন্ত্রণা সেকারণেই এতটা বিহ্বল করে তোলে আমাদের। প্রথম প্রথম দুঃখের তীব্রতা
খুব বেশি থাকে। যতই আমরা ঘটনাটাকে ভুলতে চাই, ততই গভীরভাবে সেটা দাগ কেটে বসে। তারপর আস্তে আস্তে কষ্টের পরিমাণ কমে, আমাদের মন সেই খারাপ স্মৃতিকে একটু একটু করে বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। এর অন্যথা হলেই মুশকিল, যেটা আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে হয়েছে। দুঃখের হাত থেকে বাঁচতে বাস্তবকে রিজেক্ট করছেন তিনি।
ডক্টর, প্লিজ, কোনও উপায়ই কি নেই? বিনুকে সুস্থ করে না তুলতে পারলে আমি বাঁচব না। আমার বড্ড দুশ্চিন্তা হয়। বাবান তো চলেই গেছে, এরপর যদি বিনতাও কোনও ভুল পদক্ষেপে..
এত ভেঙে পড়ছেন কেন? আমি তো বলেছি, মিসেস বিশ্বাসকে সুস্থ করে তোলার সবরকম চেষ্টাই আমরা করব। নিন, একটু জল খান।
কাঁপা হাতে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস তুলে নিল শোভন, ছোট একটা চুমুক দিয়ে মুখ মুছল।
আপনি প্লিজ বলুন ডক্টর, এখন আমার কী করা উচিত?
দেখুন একটা কথা বলি। এ ধরনের কেসে অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে কনভেনশনাল ট্রিটমেন্ট, মানে ওরাল মেডিসিন বা সাইকোথেরাপি, সম্পূর্ণ সাকসেস দেয় না। আমি বলছি না ব্যর্থ হয়, কিন্তু.. এইসব চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ, তার ওপর রিল্যাপ্স-এর একটা সম্ভাবনা রয়েই যায়। সবমিলিয়ে..
তাহলে? এই অসুখের আনকনভেনশনাল কোনও ট্রিটমেন্ট-ও আছে নাকি?
তা একটা রয়েছে, কিন্তু.. চিকিৎসার পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম, আর খরচের পরিমাণটাও বেশির দিকেই..
খরচের চিন্তা করবেন না, ডক্টর। আপনি প্লিজ ট্রিটমেন্টটার ব্যাপারে বলুন। বিনুর জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি।
বিদেশে এই অল্টারনেটিভ ট্রিটমেন্ট বেশ কয়েকবছর ধরেই যথেষ্ট জনপ্রিয়। বছর তিনেক আগে ইন্ডিয়া-তে এর ফ্র্যাঞ্চাইজি নেয় টেকনোহেলথ গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন, (মন কা সাথ)। প্রথমে হেড অফিস খোলে মুম্বইয়ে, তারপর একে একে ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদের মতো সবকটা বড় শহরে ব্রাঞ্চ বসায়। মাস ছয়েক হল কলকাতাতেও এসেছে ওরা, (মনের মানুষ) নামে। এখানে ওদের ব্রাঞ্চ অফিস ব্রেবোর্ন রোডে। আমি অ্যাড্রেস লিখে দিচ্ছি, আপনি একবার ওখানে গিয়ে কথা বলুন।
একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, এই ট্রিটমেন্ট-এ রিস্ক ফ্যাক্টর কিছু নেই তো? মানে কোনওরকম সাইড এফেক্ট..?
দেখুন, আমি এর আগে কোনও পেশেন্টকে (মনের মানুষ)- এ রেফার করিনি, তাই এতে রিস্ক আছে না নেই, বা থাকলেও কতটা, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যতদূর শুনেছি, ট্রায়াল ফেজ- এ সেরকম কোনও খারাপ এফেক্ট ধরা পড়েনি। আরোগ্য সদন-এ আমার এক কলিগ রয়েছেন, ডক্টর সিনহা, তাঁর কয়েকজন পেশেন্ট এই চিকিৎসায় যথেষ্ট উপকার পেয়েছেন। এখন আপনি ভেবে দেখুন..
ভাবাভাবির কিছু নেই, ডক্টর। জলে পড়া মানুষ খড়কুটো দেখলেও হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি কালই বিনতাকে ওখানে নিয়ে যাব। আপনি প্লিজ আমাকে অ্যাড্রেসটা দিন।
দরজা খোলামাত্র তিরবেগে ভেতরে ঢুকল স্কুল ইউনিফর্ম পরা বছর ছয়ের ফর্সা, গোলগাল ছেলেটা। কোনওরকমে পিঠের স্কুলব্যাগ, হাতের ওয়াটার বটল সোফায় নামিয়েই জড়িয়ে ধরল বিনতাকে।
আরে ছাড় আমাকে! ছেলের ভালবাসার আতিশয্যে হেসে ফেলল বিনতা। রান্না বাকি আছে। তোর ফেভারিট চিজ পাস্তা বানাচ্ছি। যা, শিগগির হাতমুখ ধুয়ে আয়।
আর একটু জড়িয়ে নিই, মাম্মা। কতক্ষণ দেখিনি তোমাকে। জানো, রনি, আমন, শামিম সবার মা স্কুল ছুটির পর ওদের নিতে আসে, কী সুন্দর গল্প করতে করতে ওরা বাড়ি ফেরে! আর আমাকে স্কুলবাসে করে ফিরতে হয়। একদম ভালো লাগে না..
ধুর পাগল! ছেলের চুলগুলো ঘেঁটে দিল ও। মাম্মাকে অফিস যেতে হয় না? আজ বাবানসোনার জন্মদিন, স্পেশাল পাস্তা বানাব, তাই হাফছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। কোথায় তুই খুশি হবি, তা না, বলছিস মাম্মা তোকে কম ভালবাসে! নকল অভিমানে বিনতা মুখ ভার করল।
এই না না! মাম্মা আমাকে ভালবাসে তো। আমি তো এমনি এমনি বলছিলাম। আরেকবার মাকে জড়িয়ে ধরল বাবান।
আর একটু জড়িয়ে নিই, মাম্মা। কতক্ষণ দেখিনি তোমাকে।
হাতে ধরা রঙিন ব্রোশিওর- টা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল শোভন। (মনের মানুষ) ব্রাঞ্চ অফিসের দোতলায়, সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ ধীমান আহুজা-র চেম্বারে বসেছিল ও। ঘরটা বেশ বড়সড়, গোটাটাই কাচের তৈরি। দেওয়ালে দেড় টনের দুটো স্প্লিট এসি বসানো। ১৯ ডিগ্রির শুকনো হাওয়ায় বেশ ঠান্ডাই লাগছিল ওর। পকেট থেকে রুমাল বের করে একবার মুখটা মুছে নিল শোভন, তারপর অন্যমনস্কতা ঝেড়ে টেবিলের ওপারে বসা মধ্যবয়সি মানুষটার দিকে তাকাল। ভদ্রলোক তখনও বলেই চলেছেন-
.. আপনি একেবারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মিঃ বিশ্বাস। প্রিয়জনকে হারানোর শোক মানুষকে পাগল করে দিতে পারে। সিভিয়ার ডিপ্রেশন থেকে ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার- কিছুই অসম্ভব নয়। আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে..
কথার মাঝখানে থামলেন আহুজা। হয়তো তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর মুখস্থ বলে চলা কথাগুলো নতুন কাস্টমারের মনে সেরকম আগ্রহ জাগাতে পারছে না। একমুহূর্ত চুপ করে রইলেন তিনি, তারপর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে আলতো হেসে আবার শুরু করলেন।
আমি জানি আপনি উৎকণ্ঠায় আছেন, মিঃ বিশ্বাস। এও বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে আপনার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। সেগুলোর উত্তর আমি অবশ্যই দেব, কিন্তু তার আগে এই ট্রিটমেন্ট বিষয়ে কিছু কথা আপনার জানা দরকার। সামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড। ভয় নেই, বোর করব না!’ আরেকবার হাসলেন আহুজা। দেখতেই পাচ্ছেন, আমি বিজ্ঞানী নই, নেহাত সেলস ম্যানেজার। একজন লেম্যান হিসেবে এই ট্রিটমেন্ট সম্বন্ধে যা বুঝেছি, আপনাকে সেটুকুই বলব। একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন প্লিজ, তারপর আপনার যা যা কোয়্যারি আছে আমাকে বলবেন।
স্মৃতি কাকে বলে? উত্তরটা বেশ সহজ। ব্রেনের স্নায়ুকোষ বা নিউরোনে সঞ্চিত তথ্যই হল স্মৃতি। কীভাবে এই তথ্য মস্তিষ্কে জমা হয়? বাইরে থেকে আসা উদ্দীপনার মাধ্যমে। বহিরাগত স্টিমুলাই ইলেক্ট্রিক্যাল ইম্পালস রূপে এক নিউরোনের অ্যাক্সন থেকে আরেক নিউরোনের ডেন্ড্রনে যায়। এক নিউরোনের অ্যাক্সন এবং অন্য নিউরোনের ডেন্ড্রনের মধ্যেকার যে ফাঁক, তাকে আমরা সাইন্যাপ্স বলি। স্মৃতি এই সাইন্যাপ্স দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়। স্টিমুলাই গিয়ে মস্তিষ্কের নিউরোনের সাইন্যাপ্স- গুলোতে বদল আনে। সেই বদলটাই পরবর্তীতে স্মৃতির রূপ নেয়। যেমনভাবে ব্ল্যাঙ্ক ডিভিডি গান বা সিনেমা রেকর্ড করতে পারে, তেমনই ব্রেনের এক বা একগুচ্ছ নিউরোন ইলেক্ট্রিক্যাল ইম্পালস-কে মেমোরি হিসেবে রেকর্ড করে রাখতে পারে।
স্থায়ীত্বের দিক দিয়ে স্মৃতি দু’ ধরনের- শর্ট টার্ম অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী এবং লং টার্ম বা দীর্ঘস্থায়ী। আবার মস্তিষ্কের কোন অংশে জমা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করেও স্মৃতির শ্রেণিবিভাগ করা হয়। হিপ্পোক্যাম্পাস, নিওকর্টেক্স, অ্যামিগডালা প্রভৃতি হল মানুষের ব্রেনের নানান প্রকোষ্ঠ, এগুলোতে সঞ্চিত স্মৃতির প্রকৃতিও একে অন্যের থেকে আলাদা। কোনওটায় শারীরবৃত্তীয় মোটর স্কিল বিষয়ক স্মৃতি জমা থাকে, কোনওটায় আবার স্কুল জীবনে শেখা পাঁচের ঘরের নামতা অথবা অমুক দেশের রাজধানীর নাম। কিন্তু সে সব নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও হবে। ‘মনের মানুষ’ কাজ করে অ্যামিগডালা নিয়ে, কারণ ইমোশনাল সমস্ত স্মৃতি ওখানেই জমা হয়।
মনোবিজ্ঞান বলে, আনন্দ, ভয়, সুখ, দুঃখ, আরাম বা ব্যথা জাতীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। দু’বছর আগের মে মাসে কতগুলো রবিবার ছিল জিজ্ঞেস করলে চট করে আমরা বলতে পারব না, কিন্তু তিন বছর বয়সে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া বা পার্কে খেলতে গিয়ে প্রথমবার নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপের স্মৃতি আমাদের মনে রয়ে যায়। এই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে ব্যথা বা আনন্দের অনুভূতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে, তাই আমরা অনায়াসে এদের কাছে ফিরে যেতে পারি। অনেকক্ষেত্রে এমনও হয়, আমাদের অজান্তেই, বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্মৃতিগুলো আমাদের মনে পড়ে যায়। এরকম উদাহরণ প্রচুর দেওয়া যায়। ধরুন আপনি একজন কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, গুরুত্বপূর্ণ বোর্ড মিটিংয়ের আগে হঠাৎ আপনার মনে পড়ে গেল যে বছর তিনেক আগের একটা মিটিংয়ে আপনার প্রেজেন্টেশন খুব খারাপ হয়েছিল। অথবা আপনি একজন ক্রিকেটার, ফাইনাল ম্যাচের দিন সকালে আপনার মনে পড়ল দশ বছর আগের গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচ, যেখানে আপনি জিরো রানে আউট হয়েছিলেন..
কিন্তু এসবের সঙ্গে বিনতার অসুস্থতার সম্পর্ক কী? চেষ্টা করেও গলা থেকে ধৈর্য হারানোর ঝাঁঝ সরিয়ে রাখতে পারল না শোভন।
দু’বছর আগের মে মাসে কতগুলো রবিবার ছিল জিজ্ঞেস করলে চট করে আমরা বলতে পারব না, কিন্তু তিন বছর বয়সে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া বা পার্কে খেলতে গিয়ে প্রথমবার নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপের স্মৃতি আমাদের মনে রয়ে যায়। এই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে ব্যথা বা আনন্দের অনুভূতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে, তাই আমরা অনায়াসে এদের কাছে ফিরে যেতে পারি। অনেকক্ষেত্রে এমনও হয়, আমাদের অজান্তেই, বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্মৃতিগুলো আমাদের মনে পড়ে যায়।
আমি সেখানেই আসছিলাম, শান্তভাবে উত্তর দিলেন আহুজা। আমাদের প্রিয়জনেদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্নেহের, ভালবাসার, আবেগের, হাসি-কান্নার। তাঁদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত প্রচণ্ডভাবে ইমোশনালি চার্জড হয়ে থাকে। ফলে এই স্মৃতিগুলো আমাদের অ্যামিগডালার একেবারে ওপরের তলে- সারফেস লেভেল-এ, সহজলভ্য অবস্থায় রয়ে যায়..
আর যদি কোনও প্রিয়জন, কোনও কাছের মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেলি?
তাহলে সেই স্মৃতিগুলো বাঁধভাঙা নদীর মতো আমাদের মনে এসে আছড়ে পড়ে। একবার নয়, বারবার। প্রতিক্ষণে মনে হতে থাকে, যে চলে গেছে তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো কত ভালো ছিল, কত সুখের ছিল! সেনসরি ওভারলোড-এ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি আমরা।
কোকিলের ডাকে বেজে ওঠা কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সবজি কাটার বোর্ড আর ছুরি একপাশে সরিয়ে রাখল বিনতা। বাবান স্কুল থেকে ফিরেছে, দরজা খুলতে হবে।
আসছি.. তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ও। ছবির মতো সাজানো দক্ষিণ কলকাতার পশ রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স (স্বর্গদ্বার)- এর দোতলা বাংলোগুলো এমনিতেই বেশ বড়সড়, তার ওপর বাড়ির পেছনদিকের রান্নাঘরটাই বেশি ব্যবহার করে বিনতা। তাই ড্রয়িংরুম পেরিয়ে দরজা খুলতে একটু সময় লেগে গেল।
মাম্মা, আমি এসে গেছি..
[চার মাস আগে]
প্লিজ ডক্টর, কিছু একটা করুন। বিনুর এই অবস্থা আর দেখতে পারছি না আমি। না ভালো করে খাচ্ছে, না ঘুমাচ্ছে। সারাদিন মনমরা হয়ে বাবানের স্কুল ইউনিফর্ম, ড্রয়িং খাতা, কমিকস আগলে বসে থাকে.. ডাকলেও সাড়া দেয় না। মাঝে মাঝে আপন মনে কথা বলে, হাসে, কাঁদে, কখনও আবার শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে, যেন সব কিছু ভুলে গেছে..
রিল্যাক্স, শোভনবাবু। আমি বুঝতে পারছি, আপনাদের জীবন এই মুহূর্তে একটা তোলপাড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনি তাও সামলে উঠেছেন, কিন্তু আপনাদের একমাত্র ছেলে অন্তরীপ- বাবানের এত অল্পবয়সে চলে যাওয়াটা আপনার স্ত্রী এখনও মেনে নিতে পারছেন না। তাই উনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে হলে ওঁর এই ডিলিউশন একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম, বাস্তবের দুঃখ- যন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা। এর বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই, আর সেই লড়াই লড়তে গেলে সবার আগে আপনাকে শক্ত থাকতে হবে।
কী করে শক্ত থাকব, ডক্টর? রোজ রোজ এক জিনিস- আমি যে আর পারছি না। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, জানেন! ভয় হয়, বাড়ি ফিরে বিনুকে কী অবস্থায় দেখব সেই ভেবে। ঘরে বেশিক্ষণ থাকলে পাগল পাগল লাগে, বেডরুমটা যেন হাঁ করে গিলতে আসে। গত পাঁচটা মাস এক বিছানায় শোওয়া সত্ত্বেও একবারও.. আমাদের কনজ্যুগাল লাইফ বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। বারোটা বছর একসঙ্গে কাটানোর পর আজ যেন আমরা হঠাৎ ছিটকে গেছি দুদিকে, দুজন অচেনা মানুষের মতো..
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, মিঃ বিশ্বাস। আত্মীয় পরিজন, পরিবারের সদস্যদের নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। প্রিয়জনকে অকালে হারানোর যন্ত্রণা সেকারণেই এতটা বিহ্বল করে তোলে আমাদের। প্রথম প্রথম দুঃখের তীব্রতা
খুব বেশি থাকে। যতই আমরা ঘটনাটাকে ভুলতে চাই, ততই গভীরভাবে সেটা দাগ কেটে বসে। তারপর আস্তে আস্তে কষ্টের পরিমাণ কমে, আমাদের মন সেই খারাপ স্মৃতিকে একটু একটু করে বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। এর অন্যথা হলেই মুশকিল, যেটা আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে হয়েছে। দুঃখের হাত থেকে বাঁচতে বাস্তবকে রিজেক্ট করছেন তিনি।
ডক্টর, প্লিজ, কোনও উপায়ই কি নেই? বিনুকে সুস্থ করে না তুলতে পারলে আমি বাঁচব না। আমার বড্ড দুশ্চিন্তা হয়। বাবান তো চলেই গেছে, এরপর যদি বিনতাও কোনও ভুল পদক্ষেপে..
এত ভেঙে পড়ছেন কেন? আমি তো বলেছি, মিসেস বিশ্বাসকে সুস্থ করে তোলার সবরকম চেষ্টাই আমরা করব। নিন, একটু জল খান।
কাঁপা হাতে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস তুলে নিল শোভন, ছোট একটা চুমুক দিয়ে মুখ মুছল।
আপনি প্লিজ বলুন ডক্টর, এখন আমার কী করা উচিত?
দেখুন একটা কথা বলি। এ ধরনের কেসে অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে কনভেনশনাল ট্রিটমেন্ট, মানে ওরাল মেডিসিন বা সাইকোথেরাপি, সম্পূর্ণ সাকসেস দেয় না। আমি বলছি না ব্যর্থ হয়, কিন্তু.. এইসব চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ, তার ওপর রিল্যাপ্স-এর একটা সম্ভাবনা রয়েই যায়। সবমিলিয়ে..
তাহলে? এই অসুখের আনকনভেনশনাল কোনও ট্রিটমেন্ট-ও আছে নাকি?
তা একটা রয়েছে, কিন্তু.. চিকিৎসার পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম, আর খরচের পরিমাণটাও বেশির দিকেই..
খরচের চিন্তা করবেন না, ডক্টর। আপনি প্লিজ ট্রিটমেন্টটার ব্যাপারে বলুন। বিনুর জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি।
বিদেশে এই অল্টারনেটিভ ট্রিটমেন্ট বেশ কয়েকবছর ধরেই যথেষ্ট জনপ্রিয়। বছর তিনেক আগে ইন্ডিয়া-তে এর ফ্র্যাঞ্চাইজি নেয় টেকনোহেলথ গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন, (মন কা সাথ)। প্রথমে হেড অফিস খোলে মুম্বইয়ে, তারপর একে একে ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদের মতো সবকটা বড় শহরে ব্রাঞ্চ বসায়। মাস ছয়েক হল কলকাতাতেও এসেছে ওরা, (মনের মানুষ) নামে। এখানে ওদের ব্রাঞ্চ অফিস ব্রেবোর্ন রোডে। আমি অ্যাড্রেস লিখে দিচ্ছি, আপনি একবার ওখানে গিয়ে কথা বলুন।
একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, এই ট্রিটমেন্ট-এ রিস্ক ফ্যাক্টর কিছু নেই তো? মানে কোনওরকম সাইড এফেক্ট..?
দেখুন, আমি এর আগে কোনও পেশেন্টকে (মনের মানুষ)- এ রেফার করিনি, তাই এতে রিস্ক আছে না নেই, বা থাকলেও কতটা, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যতদূর শুনেছি, ট্রায়াল ফেজ- এ সেরকম কোনও খারাপ এফেক্ট ধরা পড়েনি। আরোগ্য সদন-এ আমার এক কলিগ রয়েছেন, ডক্টর সিনহা, তাঁর কয়েকজন পেশেন্ট এই চিকিৎসায় যথেষ্ট উপকার পেয়েছেন। এখন আপনি ভেবে দেখুন..
ভাবাভাবির কিছু নেই, ডক্টর। জলে পড়া মানুষ খড়কুটো দেখলেও হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি কালই বিনতাকে ওখানে নিয়ে যাব। আপনি প্লিজ আমাকে অ্যাড্রেসটা দিন।
দরজা খোলামাত্র তিরবেগে ভেতরে ঢুকল স্কুল ইউনিফর্ম পরা বছর ছয়ের ফর্সা, গোলগাল ছেলেটা। কোনওরকমে পিঠের স্কুলব্যাগ, হাতের ওয়াটার বটল সোফায় নামিয়েই জড়িয়ে ধরল বিনতাকে।
আরে ছাড় আমাকে! ছেলের ভালবাসার আতিশয্যে হেসে ফেলল বিনতা। রান্না বাকি আছে। তোর ফেভারিট চিজ পাস্তা বানাচ্ছি। যা, শিগগির হাতমুখ ধুয়ে আয়।
আর একটু জড়িয়ে নিই, মাম্মা। কতক্ষণ দেখিনি তোমাকে। জানো, রনি, আমন, শামিম সবার মা স্কুল ছুটির পর ওদের নিতে আসে, কী সুন্দর গল্প করতে করতে ওরা বাড়ি ফেরে! আর আমাকে স্কুলবাসে করে ফিরতে হয়। একদম ভালো লাগে না..
ধুর পাগল! ছেলের চুলগুলো ঘেঁটে দিল ও। মাম্মাকে অফিস যেতে হয় না? আজ বাবানসোনার জন্মদিন, স্পেশাল পাস্তা বানাব, তাই হাফছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। কোথায় তুই খুশি হবি, তা না, বলছিস মাম্মা তোকে কম ভালবাসে! নকল অভিমানে বিনতা মুখ ভার করল।
এই না না! মাম্মা আমাকে ভালবাসে তো। আমি তো এমনি এমনি বলছিলাম। আরেকবার মাকে জড়িয়ে ধরল বাবান।
আর একটু জড়িয়ে নিই, মাম্মা। কতক্ষণ দেখিনি তোমাকে।
হাতে ধরা রঙিন ব্রোশিওর- টা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল শোভন। (মনের মানুষ) ব্রাঞ্চ অফিসের দোতলায়, সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ ধীমান আহুজা-র চেম্বারে বসেছিল ও। ঘরটা বেশ বড়সড়, গোটাটাই কাচের তৈরি। দেওয়ালে দেড় টনের দুটো স্প্লিট এসি বসানো। ১৯ ডিগ্রির শুকনো হাওয়ায় বেশ ঠান্ডাই লাগছিল ওর। পকেট থেকে রুমাল বের করে একবার মুখটা মুছে নিল শোভন, তারপর অন্যমনস্কতা ঝেড়ে টেবিলের ওপারে বসা মধ্যবয়সি মানুষটার দিকে তাকাল। ভদ্রলোক তখনও বলেই চলেছেন-
.. আপনি একেবারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মিঃ বিশ্বাস। প্রিয়জনকে হারানোর শোক মানুষকে পাগল করে দিতে পারে। সিভিয়ার ডিপ্রেশন থেকে ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার- কিছুই অসম্ভব নয়। আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে..
কথার মাঝখানে থামলেন আহুজা। হয়তো তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর মুখস্থ বলে চলা কথাগুলো নতুন কাস্টমারের মনে সেরকম আগ্রহ জাগাতে পারছে না। একমুহূর্ত চুপ করে রইলেন তিনি, তারপর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে আলতো হেসে আবার শুরু করলেন।
আমি জানি আপনি উৎকণ্ঠায় আছেন, মিঃ বিশ্বাস। এও বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে আপনার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। সেগুলোর উত্তর আমি অবশ্যই দেব, কিন্তু তার আগে এই ট্রিটমেন্ট বিষয়ে কিছু কথা আপনার জানা দরকার। সামান্য ব্যাকগ্রাউন্ড। ভয় নেই, বোর করব না!’ আরেকবার হাসলেন আহুজা। দেখতেই পাচ্ছেন, আমি বিজ্ঞানী নই, নেহাত সেলস ম্যানেজার। একজন লেম্যান হিসেবে এই ট্রিটমেন্ট সম্বন্ধে যা বুঝেছি, আপনাকে সেটুকুই বলব। একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন প্লিজ, তারপর আপনার যা যা কোয়্যারি আছে আমাকে বলবেন।
স্মৃতি কাকে বলে? উত্তরটা বেশ সহজ। ব্রেনের স্নায়ুকোষ বা নিউরোনে সঞ্চিত তথ্যই হল স্মৃতি। কীভাবে এই তথ্য মস্তিষ্কে জমা হয়? বাইরে থেকে আসা উদ্দীপনার মাধ্যমে। বহিরাগত স্টিমুলাই ইলেক্ট্রিক্যাল ইম্পালস রূপে এক নিউরোনের অ্যাক্সন থেকে আরেক নিউরোনের ডেন্ড্রনে যায়। এক নিউরোনের অ্যাক্সন এবং অন্য নিউরোনের ডেন্ড্রনের মধ্যেকার যে ফাঁক, তাকে আমরা সাইন্যাপ্স বলি। স্মৃতি এই সাইন্যাপ্স দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়। স্টিমুলাই গিয়ে মস্তিষ্কের নিউরোনের সাইন্যাপ্স- গুলোতে বদল আনে। সেই বদলটাই পরবর্তীতে স্মৃতির রূপ নেয়। যেমনভাবে ব্ল্যাঙ্ক ডিভিডি গান বা সিনেমা রেকর্ড করতে পারে, তেমনই ব্রেনের এক বা একগুচ্ছ নিউরোন ইলেক্ট্রিক্যাল ইম্পালস-কে মেমোরি হিসেবে রেকর্ড করে রাখতে পারে।
স্থায়ীত্বের দিক দিয়ে স্মৃতি দু’ ধরনের- শর্ট টার্ম অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী এবং লং টার্ম বা দীর্ঘস্থায়ী। আবার মস্তিষ্কের কোন অংশে জমা হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করেও স্মৃতির শ্রেণিবিভাগ করা হয়। হিপ্পোক্যাম্পাস, নিওকর্টেক্স, অ্যামিগডালা প্রভৃতি হল মানুষের ব্রেনের নানান প্রকোষ্ঠ, এগুলোতে সঞ্চিত স্মৃতির প্রকৃতিও একে অন্যের থেকে আলাদা। কোনওটায় শারীরবৃত্তীয় মোটর স্কিল বিষয়ক স্মৃতি জমা থাকে, কোনওটায় আবার স্কুল জীবনে শেখা পাঁচের ঘরের নামতা অথবা অমুক দেশের রাজধানীর নাম। কিন্তু সে সব নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও হবে। ‘মনের মানুষ’ কাজ করে অ্যামিগডালা নিয়ে, কারণ ইমোশনাল সমস্ত স্মৃতি ওখানেই জমা হয়।
মনোবিজ্ঞান বলে, আনন্দ, ভয়, সুখ, দুঃখ, আরাম বা ব্যথা জাতীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। দু’বছর আগের মে মাসে কতগুলো রবিবার ছিল জিজ্ঞেস করলে চট করে আমরা বলতে পারব না, কিন্তু তিন বছর বয়সে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া বা পার্কে খেলতে গিয়ে প্রথমবার নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপের স্মৃতি আমাদের মনে রয়ে যায়। এই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে ব্যথা বা আনন্দের অনুভূতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে, তাই আমরা অনায়াসে এদের কাছে ফিরে যেতে পারি। অনেকক্ষেত্রে এমনও হয়, আমাদের অজান্তেই, বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্মৃতিগুলো আমাদের মনে পড়ে যায়। এরকম উদাহরণ প্রচুর দেওয়া যায়। ধরুন আপনি একজন কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, গুরুত্বপূর্ণ বোর্ড মিটিংয়ের আগে হঠাৎ আপনার মনে পড়ে গেল যে বছর তিনেক আগের একটা মিটিংয়ে আপনার প্রেজেন্টেশন খুব খারাপ হয়েছিল। অথবা আপনি একজন ক্রিকেটার, ফাইনাল ম্যাচের দিন সকালে আপনার মনে পড়ল দশ বছর আগের গুরুত্বপূর্ণ একটা ম্যাচ, যেখানে আপনি জিরো রানে আউট হয়েছিলেন..
কিন্তু এসবের সঙ্গে বিনতার অসুস্থতার সম্পর্ক কী? চেষ্টা করেও গলা থেকে ধৈর্য হারানোর ঝাঁঝ সরিয়ে রাখতে পারল না শোভন।
দু’বছর আগের মে মাসে কতগুলো রবিবার ছিল জিজ্ঞেস করলে চট করে আমরা বলতে পারব না, কিন্তু তিন বছর বয়সে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া বা পার্কে খেলতে গিয়ে প্রথমবার নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপের স্মৃতি আমাদের মনে রয়ে যায়। এই স্মৃতিগুলোর সঙ্গে ব্যথা বা আনন্দের অনুভূতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে, তাই আমরা অনায়াসে এদের কাছে ফিরে যেতে পারি। অনেকক্ষেত্রে এমনও হয়, আমাদের অজান্তেই, বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্মৃতিগুলো আমাদের মনে পড়ে যায়।
আমি সেখানেই আসছিলাম, শান্তভাবে উত্তর দিলেন আহুজা। আমাদের প্রিয়জনেদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্নেহের, ভালবাসার, আবেগের, হাসি-কান্নার। তাঁদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত প্রচণ্ডভাবে ইমোশনালি চার্জড হয়ে থাকে। ফলে এই স্মৃতিগুলো আমাদের অ্যামিগডালার একেবারে ওপরের তলে- সারফেস লেভেল-এ, সহজলভ্য অবস্থায় রয়ে যায়..
আর যদি কোনও প্রিয়জন, কোনও কাছের মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেলি?
তাহলে সেই স্মৃতিগুলো বাঁধভাঙা নদীর মতো আমাদের মনে এসে আছড়ে পড়ে। একবার নয়, বারবার। প্রতিক্ষণে মনে হতে থাকে, যে চলে গেছে তার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো কত ভালো ছিল, কত সুখের ছিল! সেনসরি ওভারলোড-এ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি আমরা।
saving score / loading statistics ...