Text Practice Mode
’সাজ’ গল্প
created May 11th 2022, 14:57 by JRUllash
2
496 words
0 completed
0
Rating visible after 3 or more votes
00:00
তখন শিবঠাকুর, গৌরীকে বলল, তোমায় হালকা চাঁদের মত সাদাপানা গয়নায় সাজাব।
– তারপর কী হল গোরাদাদা?
শোলার ওপর নরুন দিয়ে নকশা তুলছে গোরা। কাজ করতে করতে আড়চোখে কুমোরকাকার আট বছরের নাতির দিকে তাকিয়ে বলল,
– শিব বিশ্বকর্মাকে বলে জলে শোলা ফুল ফোটাল। সাদা সাদা, পলকা। আর আমরা মালাকাররা তানাদের আদেশে ঠাকুরের গয়না বানিয়ে চলেচি।
ঘাটালের রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো এ বছর ত্রিশে পড়ল। আজ মহালয়া। প্রতিমা গড়া প্রায় শেষ। তেঁতুলবিচির আঠার সঙ্গে রং গুলে সরু তুলি দিয়ে মায়ের আকর্ণবিস্তৃত চোখদুটো আঁকা বাকি কেবল। প্রতিপদে চক্ষুদান করা এবাড়ির রীতি। তারপর গর্জন তেল পড়বে, রুপোর অস্ত্রে সেজে উঠবেন মা, পরবেন ডাকের সাজ। শিউলি ফুলের মতো সাদা শোলার ওপর রাংতা সেঁটে গড়ে তোলা মুকুট, চাঁদমালা, বালা, কানপাশায় মা সেজে ওঠেন সপরিবার। মালাকার গোরাচাঁদ একমনে শোলা কেটে নকশা করে মুকুট তৈরি করে চলেছে। কাজের ফাঁকেই চলছে কথা।
– তা হ্যাঁরে, তোর বাপ এবার এলনি?
কুমোর কাকা কাজের ফাঁকে নস্যি নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল।
– না গো, তার বুকে বেদনা। তার ওপর হাত কাঁপে।
– অ। তা তোর কাজ তোর বাপের চেয়েও ভালো। তোর বাপের সঙ্গে কদ্দিনের আলাপ। তোকে ছ’দিনের রেখে তোর মা মোলো। ওইটুনি ছেলে নিয়ে কী কষ্ট! বাপেরে দেখিস সোনা। বড় দুঃখী।
গোরা উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল। শরতের ছানাকাটা মেঘ জায়গায় জায়গায় জমে গিয়ে এখন সূর্যটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। রোদের আঁচ বেশ নরম। ওদিকে বাবাকে একা রান্না করে খেতে হচ্ছে হাত পুড়িয়ে। সকালে ত্রিফলা ভেজানো জলটা খাচ্ছে কিনা, কে জানে! রাতে ভিজিয়ে রাখতেই হয়তো ভুলে যাচ্ছে! যা ভুলো।
মস্ত শানবাঁধানো ঠাকুরদালানের সামনের চাতালে সবাই কাজে ব্যস্ত। ইঁদারার গভীরে ঝপ্ করে বালতি ফেলে হাতে হাতে জল তুলে ঠাকুরের পেতলের বাসন মাজছে বাগদি বৌয়েরা। গঙ্গাজলে শুদ্ধি করে বেদিতে তোলা হবে। ব্যস্ত উঠোনে কাজ আর ডেকে হেঁকে কথা একইসঙ্গে চলছে। হঠাৎ কলরব কমে এল। জমিদার মশাইয়ের একমাত্র মেয়ে মাখনবালা আদরের বেড়াল সোহাগীকে কোলে নিয়ে চাতালে এসে দাঁড়িয়েছে।
– কই গো, বাগদি বৌ, বাসন সব তোলা হল?
– এই তো দিদিরানি।
– হাত চালাও দিকি।
মাখনবালার বয়স বছর চোদ্দো। প্রতিষ্ঠা করা ইঁদারার বাঁধানো চাকে হেলান দিয়ে সে কাজ তদারক করতে লাগল। মস্ত ঝুড়িতে মাজা ঝকঝকে বাসনগুলো ঠুংঠাং শব্দ করে একে অন্যের গায়ে জড়ো হচ্ছে।
– এই ওদিকে ঘুরে আয়…
সোহাগীকে মাটিতে ছেড়ে মাখনবালা সোজা হয়ে দাঁড়াল। গত পরশু তার ঋতুস্রাব শেষ হয়েছে। রিঠে দিয়ে ঘষা ভিজে চুলগুলো হাত দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে সে পায়ে পায়ে গোরার সামনে। খানিক কাজ দেখে তারপর সে ঠাকুরের বেদির দিকে এগিয়ে গেল চোখ আঁকা দেখতে। গোরা তাকিয়ে দেখল। শ্যামলা রঙে বেশ বাড়ন্ত গড়ন। পিঠ অবধি চুল ঠাকুরের পাটের চুলের মতো কোঁকড়ানো।
– এইটুকুন মেয়ে, কত্তালি দেখ দিনি…
বৃদ্ধা বাগদি বৌ পাশের বিন্তির মাকে হাতে টিপে চাপা গলায় বলল।
– কত্তামা আঁতুড়ে মরা ছেলে বিইয়ে সেই যে বিচনা নিয়েচেন, কত্তাবাবুও সেই থেকে কেমন উড়ু উড়ু। তাই এই মেয়ে এত দাপুটে হয়ে উঠেচে। কতায় বলে না, আতুরির মেয়ে চাতুরি? এ হল তাই।
চোখে চোখে হাসি খেলে গেল দাসীদের মধ্যে।
একটা বেলি নকশা নরুনের খোঁচায় নষ্ট। আর একটা শোলার টুকরো কাটতে কাটতে গোরা ভাবতে লাগল, তার চেয়ে বয়সে ছোট একটা মেয়ে ট্যাকার গরমে মনিষ্যিকে মনিষ্যি ভাবে না, হ্যাঁ! বাপমায়ের বয়সীদের সঙ্গে অবধি হুকুমের সুরে কথা বলে? মনটা তিক্ত হয়ে উঠল তার।
– তারপর কী হল গোরাদাদা?
শোলার ওপর নরুন দিয়ে নকশা তুলছে গোরা। কাজ করতে করতে আড়চোখে কুমোরকাকার আট বছরের নাতির দিকে তাকিয়ে বলল,
– শিব বিশ্বকর্মাকে বলে জলে শোলা ফুল ফোটাল। সাদা সাদা, পলকা। আর আমরা মালাকাররা তানাদের আদেশে ঠাকুরের গয়না বানিয়ে চলেচি।
ঘাটালের রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো এ বছর ত্রিশে পড়ল। আজ মহালয়া। প্রতিমা গড়া প্রায় শেষ। তেঁতুলবিচির আঠার সঙ্গে রং গুলে সরু তুলি দিয়ে মায়ের আকর্ণবিস্তৃত চোখদুটো আঁকা বাকি কেবল। প্রতিপদে চক্ষুদান করা এবাড়ির রীতি। তারপর গর্জন তেল পড়বে, রুপোর অস্ত্রে সেজে উঠবেন মা, পরবেন ডাকের সাজ। শিউলি ফুলের মতো সাদা শোলার ওপর রাংতা সেঁটে গড়ে তোলা মুকুট, চাঁদমালা, বালা, কানপাশায় মা সেজে ওঠেন সপরিবার। মালাকার গোরাচাঁদ একমনে শোলা কেটে নকশা করে মুকুট তৈরি করে চলেছে। কাজের ফাঁকেই চলছে কথা।
– তা হ্যাঁরে, তোর বাপ এবার এলনি?
কুমোর কাকা কাজের ফাঁকে নস্যি নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল।
– না গো, তার বুকে বেদনা। তার ওপর হাত কাঁপে।
– অ। তা তোর কাজ তোর বাপের চেয়েও ভালো। তোর বাপের সঙ্গে কদ্দিনের আলাপ। তোকে ছ’দিনের রেখে তোর মা মোলো। ওইটুনি ছেলে নিয়ে কী কষ্ট! বাপেরে দেখিস সোনা। বড় দুঃখী।
গোরা উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল। শরতের ছানাকাটা মেঘ জায়গায় জায়গায় জমে গিয়ে এখন সূর্যটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। রোদের আঁচ বেশ নরম। ওদিকে বাবাকে একা রান্না করে খেতে হচ্ছে হাত পুড়িয়ে। সকালে ত্রিফলা ভেজানো জলটা খাচ্ছে কিনা, কে জানে! রাতে ভিজিয়ে রাখতেই হয়তো ভুলে যাচ্ছে! যা ভুলো।
মস্ত শানবাঁধানো ঠাকুরদালানের সামনের চাতালে সবাই কাজে ব্যস্ত। ইঁদারার গভীরে ঝপ্ করে বালতি ফেলে হাতে হাতে জল তুলে ঠাকুরের পেতলের বাসন মাজছে বাগদি বৌয়েরা। গঙ্গাজলে শুদ্ধি করে বেদিতে তোলা হবে। ব্যস্ত উঠোনে কাজ আর ডেকে হেঁকে কথা একইসঙ্গে চলছে। হঠাৎ কলরব কমে এল। জমিদার মশাইয়ের একমাত্র মেয়ে মাখনবালা আদরের বেড়াল সোহাগীকে কোলে নিয়ে চাতালে এসে দাঁড়িয়েছে।
– কই গো, বাগদি বৌ, বাসন সব তোলা হল?
– এই তো দিদিরানি।
– হাত চালাও দিকি।
মাখনবালার বয়স বছর চোদ্দো। প্রতিষ্ঠা করা ইঁদারার বাঁধানো চাকে হেলান দিয়ে সে কাজ তদারক করতে লাগল। মস্ত ঝুড়িতে মাজা ঝকঝকে বাসনগুলো ঠুংঠাং শব্দ করে একে অন্যের গায়ে জড়ো হচ্ছে।
– এই ওদিকে ঘুরে আয়…
সোহাগীকে মাটিতে ছেড়ে মাখনবালা সোজা হয়ে দাঁড়াল। গত পরশু তার ঋতুস্রাব শেষ হয়েছে। রিঠে দিয়ে ঘষা ভিজে চুলগুলো হাত দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে সে পায়ে পায়ে গোরার সামনে। খানিক কাজ দেখে তারপর সে ঠাকুরের বেদির দিকে এগিয়ে গেল চোখ আঁকা দেখতে। গোরা তাকিয়ে দেখল। শ্যামলা রঙে বেশ বাড়ন্ত গড়ন। পিঠ অবধি চুল ঠাকুরের পাটের চুলের মতো কোঁকড়ানো।
– এইটুকুন মেয়ে, কত্তালি দেখ দিনি…
বৃদ্ধা বাগদি বৌ পাশের বিন্তির মাকে হাতে টিপে চাপা গলায় বলল।
– কত্তামা আঁতুড়ে মরা ছেলে বিইয়ে সেই যে বিচনা নিয়েচেন, কত্তাবাবুও সেই থেকে কেমন উড়ু উড়ু। তাই এই মেয়ে এত দাপুটে হয়ে উঠেচে। কতায় বলে না, আতুরির মেয়ে চাতুরি? এ হল তাই।
চোখে চোখে হাসি খেলে গেল দাসীদের মধ্যে।
একটা বেলি নকশা নরুনের খোঁচায় নষ্ট। আর একটা শোলার টুকরো কাটতে কাটতে গোরা ভাবতে লাগল, তার চেয়ে বয়সে ছোট একটা মেয়ে ট্যাকার গরমে মনিষ্যিকে মনিষ্যি ভাবে না, হ্যাঁ! বাপমায়ের বয়সীদের সঙ্গে অবধি হুকুমের সুরে কথা বলে? মনটা তিক্ত হয়ে উঠল তার।
saving score / loading statistics ...